১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল হানাদার বাহিনী কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। কবরস্থানটি অবহেলিত ও অযত্ন। ধানক্ষেতের মাঝখানে জঙ্গলে ঘেরা চারটি সমাধি। চার শহীদের নামের প্রায় বিবর্ণ চিহ্ন নীরবে শহীদদের কবরের সাক্ষ্য দিচ্ছে। আপনি যদি না জানেন তাহলে এটি একটি কবরস্থান নাকি বন তা বোঝার কোন উপায় নেই।
জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে এবং জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর কুড়িগ্রামবাসী তখন উত্তেজিত হয়ে ওঠে সারা দেশ। ৩০ মার্চ রংপুরের ইপিআর উইংয়ের তৎকালীন সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেস কুড়িগ্রামে আসেন। তার নির্দেশে রংপুরের ইপিআর শাখার অধীনস্থ ক্যাপ্টেন নায়েক সুবেদার বোরহান উদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে কুড়িগ্রামে এসে অবস্থান নেন। ৩১ মার্চ কুড়িগ্রামে স্থানীয় আনসার, পুলিশ, ছাত্র ও ইপিআরদের নিয়ে একটি যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়।
১লা এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তিস্তা সেতুর পূর্ব তীরে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে। সেখান থেকে ৩ এপ্রিল তিস্তা নদীর কাউনিয়া এলাকায় হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনারা তিস্তা সেতুর পশ্চিম তীরে অবস্থান নেয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। ৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা লালমনিরহাট দখল করলে, ৫ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা কুড়িগ্রামে আসেন এবং জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেন।
পাকিস্তানি সেনারা সাঁজোয়া নৌবহর নিয়ে লালমনিরহাট ও রংপুর থেকে কুড়িগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। বিকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। তারা বর্তমান সার্কিট হাউসের সামনে অবস্থান নিয়ে তৎকালীন কুড়িগ্রাম উপ-কারাগারে হামলা চালায়। তৎকালীন নিম্ন কারাগারে দায়িত্বরত একজন অবাঙালি জমাদারের সহায়তায় কারাগারের কর্তা শেখ হেদায়েত উল্লাহ এবং পাঁচজন কারারক্ষীকে পাকিস্তানি বাহিনী ডেকে পাঠায় এবং পূর্ব প্রান্তে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে সারিবদ্ধ করে। বর্তমান সার্কিট হাউসের সামনের সড়কে গুলি চালায়। কারারক্ষী লাল মোহাম্মদ, সাজ্জাদ হোসেন, আনসার আলী ও জহির উদ্দিনকে নির্যাতন করা হয়।
কারারক্ষীদের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থাতেই কারাগারের ব্যারাকের পেছনে মূল কারাগারের প্রাচীরের ঠিক পূর্বে একটি বড় গর্তে চার শহীদকে দাফন করা হয়। আরেক শহীদ শেখ হেদায়েত উল্লাহ ইন কমান্ডকে কারাগারের পশ্চিম পাশে সাবেক কাউন্সিল চেয়ারম্যান আবদুস ছালামের বাড়ির উঠানে দাফন করা হয়।
এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও সংহতি কুড়িগ্রামের পরিচালক হারুনুর রশিদ লাল বলেন, “আমার চোখের সামনে কারারক্ষীদের হত্যা করা হয়েছে। তখন আমাদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। তখন আমাদের অস্ত্রগুলো আড়ালে রাখা ছিল। না হলে আমরা প্রতিহত করতাম। পরে আমি সহযোদ্ধাদের নিয়ে তাদের দাফনের ব্যবস্থা করি।