বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থান। তাজহাট জমিদারবাড়ি তার সুন্দর স্থাপত্য এবং জমিদারবাড়ির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত ইতিহাসের সাথে দেখার জন্য একটি সুন্দর স্থান।
ঐতিহাসিক প্রাসাদকে ঘিরে অনেক ইতিহাস। তাজহাট জমিদারবাড়ি দেশের বিশাল ও অনন্য সুন্দর স্থাপনাগুলোর একটি।
ঢাকার আহসান মঞ্জিলের সাথে স্থাপত্যশৈলীর বেশ মিল রয়েছে। বর্তমানে যাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রংপুর শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে তাজহাট গ্রামে অবস্থিত।
প্রাসাদটি ২০ শতকের মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মহারাজা গোপাল রায় হিন্দু ধর্মের অনুসারী এবং স্বর্ণকার ব্যবসায়ী ছিলেন।
তাজহাট জমিদারবাড়ি উত্তরবঙ্গের রংপুরের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। তাজহাট এখন জমিদারবাড়ির জন্য পরিচিত হলেও অতীতে তাজহাট তার সুন্দর ‘তাজ’ বা মুকুটের জন্য বিখ্যাত ছিল।
এই ‘তাজ’ ভারতের প্রায় সব রাজা ও ভূস্বামীদের পছন্দ ছিল। প্রাসাদটিতে রয়েছে অসংখ্য পুরাকীর্তি ও প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। তাজহাট জমিদারবাড়ির প্রাসাদটি প্রায় ২১০ ফুট চওড়া এবং চারতলা উঁচু। স্থাপত্যশৈলী পুরাতন মুঘল স্থাপত্যের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
প্রাসাদের মাঝখানে একটি বিশাল গম্বুজ এবং একটি সুন্দর ২২টি কাঠের সিঁড়ি রয়েছে যা মূল ভবনের উত্তর অংশের কেন্দ্রস্থলে ২য় তলায় যা উভয় দিকে প্রসারিত।
এ ছাড়া ২য় তলায় যাওয়ার জন্য প্রাসাদের পেছন থেকে লোহার নকশার মজবুত ঝুলন্ত সিঁড়ি রয়েছে।
সিঁড়ির রেলিংগুলো দেখতে চমৎকার। দেখতে ফুলের মতো। প্রাসাদের সামনে থেকে ২য় তলায় যাওয়ার জন্য একটি বড় গ্যালারি-স্টাইলের সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়িটি তিনটি স্তরে বিভক্ত দেখা যায়।
১ম স্তরে ১টি ধাপ রয়েছে, যেহেতু এটি ২য় স্তরে আরোহণ করে, সামান্য নেমে আসে এবং আরেকটি ১৪টি ধাপ একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন আয়তক্ষেত্রাকার প্ল্যাটফর্ম অতিক্রম করে, যা ২য় তলার ছাদের সাথে সংযুক্ত, যাকে ৩য় স্তর হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
ভবনগুলো দেখতে মসজিদের মতো। তবে যা রাজবাড়ীকে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রাসাদের থেকে আলাদা করেছে তা হল সিঁড়ি। এখানে মোট ৩১টি সিঁড়ি রয়েছে, প্রতিটি ইতালীয়-শৈলী মার্বেল দিয়ে তৈরি। সিঁড়ি থেকে জাদুঘর পর্যন্ত পুরোটাই একই পাথর দিয়ে তৈরি।
ঐতিহাসিক এই জমিদারবাড়ির ইতিহাস বেশ বৈচিত্র্যময়। মহারাজা গোবিন্দ লালের ছেলে গোপাল লাল তাজহাট জমিদারবাড়ির নির্মাতা বলে জানা যায়।
মূলত, এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা মান্নানলাল রায় সুদূর পাঞ্জাব থেকে রংপুরের একটি সমৃদ্ধ স্থান মাহিগঞ্জে সোনার ব্যবসা করতে এসেছিলেন। ১৮১৯ সালে গোবিন্দলাল জমিদারবাড়ির স্থলাভিষিক্ত হন।
তিনি একজন স্বাধীন এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অবদানের জন্য ১৮৮৫ সালে ‘রাজা’, ১৮৯২ সালে ‘রাজা বাহাদুর’, ১৮৯৬ সালে ‘মহারাজা’ লাভ করেন।
এখানে তিনি হীরা, গয়না এবং সোনার অলঙ্কার ব্যবসা করতেন। প্রথমদিকে তিনি বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান হীরা, রত্নখচিত মুকুট বা টুপির ব্যবসা করতেন।
তাজ বিক্রির জন্য এখানে একটি বাজার স্থাপিত হয়েছিল, যা পরবর্তীতে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার কোম্পানির প্রসারের ফলে এখানে হীরার গহনার বাজার গড়ে ওঠে। এই তাজ কোম্পানির উপর ভিত্তি করে জমিদারবাড়িকে তাজহাট জমিদারবাড়ি বলা হতো।
এই সুন্দর স্থাপনাটি তৈরি করতে প্রায় ১০ বছর সময় লেগেছে।
যাদুঘর:
১৯৯৫ সালে, বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রাসাদটিকে একটি সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসাবে ঘোষণা করে। ২০০৫ সালে, রংপুর জাদুঘরটি প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তরিত হয়।
তাজহাট জমিদারবাড়ির প্রাসাদ ময়দানে রয়েছে বিস্তীর্ণ খালি মাঠ, প্রাসাদের দুপাশে সারি সারি গাছ ও দুটি পুকুর। জাদুঘরের মার্বেল সিঁড়িতে ১০ এবং ১১ শতকের পোড়ামাটির বস্তু সহ বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে।
এ ছাড়া এখানে সরলা দেবীর ব্যবহূত সেগুন কাঠের তৈরি বাক্স, বিভিন্ন পুরনো পত্রিকা, শিবপত্নী পার্বতীর মূর্তি, বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক, রাজা-বাদশাহদের ব্যবহূত জিনিসপত্র, মৃত্পাত্র, মাটির পাত্র, হস্তলিপি, ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক রয়েছে এখানে।
এ ছাড়াও রয়েছে নারী মূর্তি, লোহার দ্রব্যাদি, সাঁওতালদের ব্যবহূত তীর, লাল পাথরের টুকরো, পাহাড়পুর বিহার থেকে সংগৃহীত নারী মূর্তি, পাথরের নোড়া, আক্রমণাত্মক যোদ্ধার মূর্তি।
মহাভারত, রামায়ণ, কবি শেখ সাদী ও বাদশাহ নাসির উদ্দিনের স্বহস্তে লেখা কোরআন শরিফ, গাছের বাঁকলে লেখা সংস্কৃত হস্তলিপি, বদনা,তুলট কাগজে লেখা হস্তলিপি, এবং ছোট্ট কোরআন শরিফও রয়েছে।