নড়াইল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি জেলা। কথিত আছে, বাংলার সুবাদার আলীবর্দী খানের শাসনামলে বর্গী ও পাঠান বিদ্রোহীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের নিপীড়ন শুরু করে। আলিবর্দীর মুঘল বাহিনী বর্গী ও পাঠানদের সম্পূর্ণভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়। বর্গী ও পাঠান দস্যুরা তখন তাদের নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সুবা বাংলার পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা তাদের জীবনের ভয়ে নিরাপদ এলাকায় পালিয়ে যায়। এ সময় মদনগোপাল দত্ত নামে সুবাদারের এক কর্মচারী সপরিবারে নৌকায় করে কিসমত কুড়িগ্রামে আসেন। সেখানে তিনি কচুরির মজবুত ধাপেরএক ফকিরকে যোগাসনে বসে দেখতে পান। কথিত ফকির দত্ত মশাইকে তাঁর নড়িটি (লাঠি) নিবেদন করেন এবং এই নড়িটি পরে আশীর্বাদস্বরূপ দাঁড়ায়। মদনগোপাল দত্ত ধীরে ধীরে ফকির বা সাধক আউলিয়াদের কাছ থেকে নড়িটি বা লাঠি গ্রহণ করে প্রতিপত্তি অর্জন করেন। এভাবে কিসমত অঞ্চলের সেই জায়গার নাম কুড়িগ্রাম নড়াল। নড়ালের লিখিত রূপ নড়াইল। স্থানটি নড়িয়াল নামে পরিচিতি লাভ করে। মদনগোপাল দত্তের নাতি হলেন বিখ্যাত রূপরাম দত্ত। নড়িয়াল জমিদারদের প্রথম পুরুষ ছিলেন রূপরাম দত্ত। যাইহোক, মদনগোপাল দত্তএবং তার উত্তরসূরিরা নড়াইল ফকিরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার জন্য নড়িয়াল নামটি স্থায়ী করেছিলেন। তারা কোনো পরিবর্তন করেনি। ১৮৬৩ সালে, নড়াইলের নীল বিদ্রোহের ফলে একটি মহকুমা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হলে ব্রিটিশ সরকার মহিষখোলা মৌজায় মহকুমার সদর দপ্তর স্থাপন করে। তাই ব্রিটিশ শাসনামলে মুঘল আমল থেকে ‘নড়াল’ নামটি নড়াইল নামে পরিচিতি লাভ করে। কিসমত কুড়িগ্রাম বা কুড়িগ্রাম নড়াইল বা প্রাচীন কিসমত কুড়িগ্রামের নড়াইল মুঘল শাসনের পূর্বে সুলতানি আমলে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ও সেনা ক্যাম্প ছিল।
গবেষক এস.এম. রইস উদ্দিন আহমদের মতে, লড়েআল থেকে নড়াইল নামের উৎপত্তি। যারা শক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের স্থানীয় ভাষায় লড়ে বলা হয়। হযরত খান জাহান আলীর সময়ে রাজ্যের সীমান্তে সীমান্ত রক্ষী মোতায়েন ছিল। নড়াইল এলাকা নদী, খাল-বিল বেষ্টিত। রাজ্যের সীমান্তে খাল খনন ও পরিখা তৈরি করা হয়। খাল বা খালের ধারে চওড়া উঁচু আইলে রক্ষী বা রক্ষীরা দাঁড়িয়ে থাকত। জনশ্রুতি আছে যে লড়াল > নড়াইল নামের উৎপত্তি লাদল থেকে।
আরেকটি জনপ্রিয় মত হল নড়াইল নামটি নড়ানো থেকে এসেছে। বাংলাদেশের অনেক স্থানের নামের ইল প্রত্যয় আছে যেমন টাঙ্গাইল, ঘাটাইল, বাসিল, নান্দাইল ইত্যাদি। প্রতিটি সহানের নামকরণে একটি কিংবদন্তি বা লোককাহিনী রয়েছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে নড়াল বা নড়াইল নামের উৎপত্তি একটি বড় পাথর সরানোর উপর ভিত্তি করে।
তবে বাংলাপিডিয়া এবং কয়েকজন লেখকের বিভিন্ন লেখায় পাওয়া নামকরণের ইতিহাস নিম্নরূপ:-
নড়াইল জেলার নামকরণঃ
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, প্রায় ১০ লক্ষ বছর আগে গঙ্গা নদীর পলিমাটি দ্বারা গঙ্গা বদ্বীপ গঠিত হয়েছিল। সমগ্র বাংলার নড়াইল জেলার অন্তর্গত একটি এলাকা এবং দক্ষিণবঙ্গের ব-দ্বীপ।” নড়াইল নাম সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। জনশ্রুতি আছে, হযরত খানজাহান আলী (রহ.) দক্ষিণবঙ্গে ইসলাম প্রচারের জন্য এসে খেলাফতাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং রাজধানী বাগেরহাট প্রতিষ্ঠা করেন। বাগেরহাটে তার মাজার আছে। খিলাফত রাষ্ট্রের আয়তন সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য নেই। অনেকের মতে, খেলাফতাবাদ রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের সীমানা ছিল বর্তমান নড়াইল এলাকা। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সীমান্তরক্ষীরা যুদ্ধে পারদর্শী ছিল। এই কারণেই মানুষ তাদের ” লড়ে” বলে ডাকত। ” লড়ে” একটি আঞ্চলিক শব্দ। “লড়াই” শব্দটা সাধারণ মানুষ বুঝত- যারা লড়াই করে।
আর হযরত খান জাহান আলী (রহ.)-এর সময়ে নড়াইল এলাকা খাল-বিল-নদীতে পরিপূর্ণ ছিল। তাই লড়েরা একটি উঁচু আইল তৈরি করে এর ওপারে সীমান্ত পাহারা দিত। লোকেরা এই আইলটিকে “লড়ে আল” বলে। পরবর্তী সময়ে “লড়ে আল” থেকে নড়াইল নামটি এসেছে। কিছু সময়ে লড়েরা চলে আসে এবং গ্রামগুলি তৈরি করা হয়। লোকে গ্রামটিকে ‘লড়ে গাতী’ বলে ডাকে। গাতী শব্দের অর্থ গ্রাম। ‘লড়ে গাতী’ পরে ‘নড়াগাতি’ হয়। ‘নড়াগাতি’ কালিয়া উপজেলায় (বর্তমানে একটি নতুন থানা) অবস্থিত। নড়াগাতির পাশে যে নদীটি ছিল তাকে ‘লড়াগাতী নদী’ও বলা হত। পরে নাম হয় ‘নড়াগাতী নদী’। নড়াগাতী নামে একটি বন্দরও ছিল। বর্তমানে একটি বাজার চলছে। তাই অনেকেই ‘লড়া আইল’ থেকে ‘নড়াইল’ নাম পরিবর্তনকে সমর্থন করেছেন।”