খেরুয়া মসজিদ – বগুড়া

খেরুয়া মসজিদ বাংলাদেশের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ। এই মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যশৈলীর সাথে প্রাক-মুঘল সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে নির্মিত। প্রায় ৪৩০ বছর ধরে গড়ে ওঠা এই মসজিদটি বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলা সদরের খোন্দকার টোলা মহল্লায় অবস্থিত।

মসজিদটি তার বিশাল চার কোণার মিনার এবং প্রশস্ত দেয়ালের জন্য টিকে আছে। পাথরে খোদাই করা নকশা ক্ষয়ে গেছে এবং চুন-সুরকির আবরণ খসে পড়েছে। পাতলা লাল ইটের চুন দেয়ালগুলো ১.৮১ মিটার চওড়া। খেরুয়া মসজিদের ছাদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। খেরুয়া মসজিদটি উত্তর থেকে দক্ষিণে ১৭.২৭ মিটার, প্রস্থ ৭.৪২ মিটার চওড়া। পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলানযুক্ত দরজা। মাঝেরটি আকারে বড়। উত্তর-দক্ষিণ দিকে একটি করে খিলানযুক্ত দরজা। কোন ফ্রেম নেই। ফলে দরজার সামনে কোন পাল্লা ছিল না। বড় সদর দরজার নিচে একটি কালো পাথরের প্রাঙ্গণ। পূর্ব দরজা বরাবর পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরে তিনটি মেহরাব। মেহরাবগুলোর উপরের অংশে সুন্দর নকশা করা হয়েছে। মসজিদের নিচের অংশের ভূমি পরিকল্পনা মুঘল স্থাপত্যের। উপরের অংশটি প্রাক-মুঘল সালতানাত শৈলীতে। দেয়াল থেকে একটু এগিয়ে চার কোনায় চারটি বিশাল মিনার। ছাদে তিনটি অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ রয়েছে যার ব্যাস ৩.৭১ মিটার। কার্নিশ দেখতে ধনুকের মতো বাঁকা। মেঝে খিলান প্যানেল প্রসাধন সঙ্গে আচ্ছাদিত করা হয়। দেয়াল গাঁথনি খুব সুন্দর। ইটের বিন্যাস এবং খাড়া প্যানেল তৈরির মাধ্যমে নান্দনিক বৈচিত্র আনা হয়। সামনের ইটগুলিতে ফুল-লতা-পাতা খোদাই করা আছে। মিনার, গম্বুজ, নকশা ও বৈচিত্র্যময় গাঁথুনি দিয়ে পুরো স্থাপত্যটি হয়ে উঠেছে অত্যন্ত নান্দনিক। মসজিদের সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা আয়তাকার মাঠ। তাল, নারকেল, আম ও তালগাছের সারি মসজিদের কিনারায়। একদিকে মৌসুমি ফুলের গাছও রয়েছে। পুরো এলাকাটি ইটের দেয়ালে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। মোট এলাকা প্রায় ৫৯ শতাংশ। নামাজের সময় সাধারণত মুসল্লিরা ছাড়া কেউ প্রবেশ করে না। তাই প্রাঙ্গণটি শান্ত এবং খুব পরিষ্কার। সবুজ চারপাশে প্রাচীন তিন গম্বুজ স্থাপত্যটি মনোরম দেখায়।

মসজিদের সামনের দেয়ালে লেখা শিলালিপি অনুসারে, এটি ১৫৮২ সালে জওহর আলী কাকশালের পুত্র মির্জা মুরাদ খান কাকশাল দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। তুর্কিদের ‘কাকশাল’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ঘোড়াঘাট অঞ্চল তুর্কি জায়গিরদারদের অধীনে ছিল। মির্জা মুরাদ খান কাকশালের পরিচয় জানা যায়নি। শেরপুর তখন ঘোড়াঘাটের অধীনে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। মির্জা মুরাদ খান কাকশাল শেরপুরের জায়গিরদার বা ফৌজদার বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা।

খেরুয়া মসজিদের নামকরণ স্পষ্ট নয়। আবুল কালাম মোহাম্মদ জাকারিয়া তার বাংলাদেশের পুরাকীর্তি গ্রন্থে বলেছেন: ‘এই মসজিদ খেরুয়ার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি। আরবি বা ফারসিতে খেরুয়া শব্দ নেই।’ কিন্তু ফারসিতে একটি শব্দ আছে ‘খয়ের গাহ’। যার অর্থ ‘একটি জায়গার মধ্যে’। রাজা মানসিংহ যখন বাংলার সুবাদার ছিলেন তখন তিনি শেরপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গ আর নেই। তবে মসজিদটি শেরপুর দুর্গের মধ্যে নির্মিত হলে অনুমান করা যায় খেরুয়া নামটি ‘খয়ের গাহ’ থেকে এসেছে।

পুরনো এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করায় মসজিদের পরিবেশ ভালো।

কিভাবে যাব:

বগুড়ার শেরপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে গ্রামীণ সবুজ ছায়াঘেরা খন্দকারটোলা গ্রামে এই মসজিদটি অবস্থিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *